সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩

এইচএসসিতে পাস ও জিপিএ ৫ কমার তিন কারণ

 

ভালো ফলের খবরে আনন্দে মেতে ওঠে শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাজধানীর নটর ডেম কলেজে। ছবি : কালের কণ্ঠ

চলতি বছর এইচএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) ও সমমানের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের পাসের হার গত বছরের তুলনায় ৭.৩১ শতাংশ কমেছে। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কমেছে ৮৩ হাজার ৬৮৭ জন, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন কারণে বিগত বছরগুলোর তুলনায় ফল খারাপ হয়েছে। তবে শিক্ষামন্ত্রীসহ বোর্ড কর্মকর্তাদের দাবি, করোনার আগের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ফল স্বাভাবিক ধারাতেই আছে।


গতকাল রবিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এইচএসসি-২০২৩-এর ফল প্রকাশ উদ্বোধন করেন। সকাল ১১টায় তা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ফলের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।


প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুকরণীয় বলে বিবেচনা করছে বিশ্বের অন্যান্য দেশ।


বর্তমানে দেশের শিক্ষার হার ৭৬.০৮ শতাংশ। করোনার কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালে সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা সব সময় আমাদের শুনতে হয়। এখন দেখছি উল্টো।


পরীক্ষায় জিপিএ ৫ ও পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। ছেলেদের পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’

চলতি বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন। অর্থাৎ পাসের হার ৭৮.৬৪ শতাংশ।


জিপিএ ৫ পেয়েছে ৯২ হাজার ৫৯৫ জন শিক্ষার্থী। গত বছর এইচএসসি-২০২২-এ শিক্ষার্থী পাসের হার ছিল ৮৫.৯৫ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ বিগত বছরের তুলনায় পাসের হার কমার পাশাপাশি জিপিএ ৫ প্রাপ্তি কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে তিনটি কারণে এবারের ফল গতবারের চেয়ে কিছুটা পিছিয়েছে, তা হলো করোনার পর এ বছর থেকে সব বিষয়ে পূর্ণ সিলেবাস চালু এবং পূর্ণ নম্বরে ও তিন ঘণ্টায় পরীক্ষা নেওয়া। এ ছাড়া ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়া এবং করোনার কারণে যথাযথ শ্রেণি পাঠদান না পাওয়ায় সেই ঘাটতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ।


শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘এর আগে করোনার কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালে বিশেষ ছাড় দিয়ে পরীক্ষাগুলো নেওয়া হয়। এসব কারণে গত বছরের তুলনায় ফল খারাপ হয়েছে বলে মনে হতে পারে। তবে ২০১৯ সালের ফলের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে।’


২০১৯ সালের ফলে দেখা যায়, পাসের হার ছিল ৭৩.৯৩ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪৭ হাজার ২৮৬ জন।


যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে ইংরেজি বিষয়ে। এতে পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী।’


শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সাধারণ ৯টি বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণের হার ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ। অন্যদিকে ইংরেজি বিষয়ে উত্তীর্ণের হার ৭৭ থেক ৮৮ শতাংশ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্য ১৩.১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া রাজশাহীতে ১৬.৮২ শতাংশ, কুমিল্লায় ১৮.০২ শতাংশ, যশোরে ২২.৬৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১১.০৯ শতাংশ, বরিশালে ১৩.৯৯ শতাংশ, সিলেটে ১৭.৮১ শতাংশ, দিনাজপুরে ১৭.২০ শতাংশ ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের ২৪.৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ফেল করেছে।


ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে থাকা একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জানায়, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর ভিন্ন আঙ্গিকে প্রশ্নপত্র হয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি বিষয়ে প্রশ্নপত্র তুলনামূলকভাবে কঠিন ছিল। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি।


পাস, জিপিএ ৫ কমেছে তিন কারণেঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বরাবরের মতোই প্রশ্নপত্র করেছি। এতে কী ভিন্নতা ছিল, তা শিক্ষার্থীরাই বলতে পারবে। এ ছাড়া ইংরেজি বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা বরাবরই দুর্বল।’


ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের যথেষ্ট সময় পায়নি। প্রস্তুতিতে ঘাটতি নিয়েই তারা পরীক্ষা দিয়েছে, যা তাদের ফলে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। আশা করি, আগামী বছর থেকে এ সমস্যা আর থাকবে না। তবে করোনার আগের ফলের সঙ্গে তুলনা করলে এই ফলকে খারাপ বলা যাবে না।’


৪২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী অকৃতকার্য


৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনুত্তীর্ণ হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পাঁচটি, রাজশাহীতে চারটি, কুমিল্লায় একটি, যশোরে সাতটি, চট্টগ্রামে তিনটি, দিনাজপুরে ১৬টি, ময়মনসিংহে চারটি। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে রয়েছে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।


শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৯৫৩টি। এর আগে ২০২২ সালে শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫০। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল পাঁচ।


পাসের হার ও জিপিএ ৫-এ ছাত্রীরা এবারও এগিয়ে


শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে এ বছরও ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা এগিয়ে। ছাত্রের চেয়ে ৩.৮১ শতাংশ বেশি ছাত্রী পাস করেছে এবং ছয় হাজার ১৩৫ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছে।


উত্তীর্ণ ছাত্রসংখ্যা ছয় লাখ ৮৯ হাজার ২৩ জন, পাসের হার ৭৬.৭৬ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪৩ হাজার ২৩০ জন। উত্তীর্ণ ছাত্রীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৩ জন, পাসের হার ৮০.৫৭ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪৯ হাজার ৫৯৫ জন।


পাসের হারে বরিশাল এগিয়ে, পিছিয়ে যশোর 


সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে পিছিয়ে পড়েছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, ইংরেজি পরীক্ষা কঠিন হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত ফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ কারণে এই বোর্ডে শিক্ষার্থীদের পাসের হার কমেছে, প্রভাব পড়েছে জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে। যশোর বোর্ডে পাসের হার ৬৯.৮৮ শতাংশ।


৮০.৬৫ শতাংশ পাসের হার নিয়ে প্রথম স্থানে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে পাসের হার ঢাকায় ৭৯.৪৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭৮.৪৬ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৫.৩৯ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৪.৪৮ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭৪.৪৫ শতাংশ, সিলেটে ৭১.৬২ শতাংশ ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে ৭০.৪৪ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৯১.২৫ শতাংশ ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৯০.৭৫ শতাংশ।


বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে


পাসের হারে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে। তাদের পাসের হার ৮৭.৮৪ শতাংশ। মানবিক বিভাগে পাসের হার ৭০.৭৯ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৭৭ শতাংশ।


শেয়ার করুন

0 coment rios: