বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০২৩

ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সকাল-সন্ধ্যা দুআ পড়ুন

ছবিঃ ইমদাদুল হক মামুন


লেখকঃমাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

বিভিন্ন সময় ডেঙ্গুজ¦রের প্রকোপ দেখা দেয়। এবারও মহামারির রূপ ধারণ করেছে। সবার মাঝে বিরাজ করছে ভীতি ও আতঙ্ক। এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহর শরণাপন্ন হলে পেতে পারি স্বস্তিলাভ করতে পারি সে আতঙ্ক থেকে পরিত্রাণ। ইসলামে তো সব বিষয়েই আছে অনুপম ও বিকল্পহীন নির্দেশনা। এক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের সুন্দর ও সুমহান শিক্ষা।

ডেঙ্গুজ¦র সাধারণত এডিস মশার ভাইরাস থেকে সৃষ্টি হয়। এ মশা দংশন করে আর এর ভাইরাস থেকে ডেঙ্গুজ¦র হয়। সাপবিচ্ছুএডিস মশা ও অন্যান্য বিষাক্ত কীট-পতঙ্গের বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকার জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করতে বলেছেনএকটি দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। একীন ও বিশ্বাসের সাথে তা নিয়মিত পাঠ করলে কোনো বিষাক্ত প্রাণীর বিষ ক্ষতি করবে না। বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ হয়তো দংশন করবেকিন্তু বিষক্রিয়া প্রকাশ পাবে না। দংশনের কারণে কোনো ক্ষতি হবে না।

বিচ্ছু কোনো ক্ষতি করবে না

আবু হুরায়রা রা. বলেন

أَنَّ رَجُلًا مِنْ أَسْلَمَ قَالَمَا نِمْتُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ، فَقَالَ لَه رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَمِنْ أَيِّ شَيْءٍ؟ فَقَالَلَدَغَتْنِي عَقْرَب، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَأَمَا إِنَّكَ لَوْ قُلْتَ حِينَ أَمْسَيْتَ أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ، لَمْ تَضُرَّكَ.

আসলাম গোত্রের এক লোক বললআজ রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেনকীসের কারণে?

সে বললআমাকে বিচ্ছু দংশন করেছিল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনশোনোতুমি যদি সন্ধ্যায় নিম্নের দুআটি পড়তে তাহলে বিচ্ছুর দংশন তোমার ক্ষতি করতে পারত না। দুআটি হলÑ

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ.

মুয়াত্তা মালেকহাদীস ১১সহীহ মুসলিমহাদীস ২৭০৯সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৮৯৮মুসনাদে আহমাদহাদীস ৮৮৮০

উল্লিখিত রেওয়ায়েতে সন্ধ্যায় দুআ পড়ার কথা এবং শুধু রাতের বেলা বিচ্ছুর ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে। অন্য রেওয়ায়েতে দিনের নিরাপত্তার কথাও এসেছে। আবু ইয়ালা রাহ. তার মুসনাদ গ্রন্থে যে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন এর শেষে আছে

فَمَنْ قَالَهَا حِينَ يُمْسِي وَحِينَ يُصْبِحُ لَمْ تَضُرَّهُ .

যে সন্ধ্যা ও সকালে দুআটি পড়বেবিচ্ছু তার ক্ষতি করতে পারবে না। মুসনাদে আবু ইয়ালাহাদীস ৬৬৮৮

আরেকটি রেওয়ায়েতে এভাবে বলা হয়েছে

مَنْ قَالَ حِينَ يُصْبِحُ وَحِينَ يُمْسِيأَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ، لَمْ يَضُرَّهُ شَيْءٌ (إسناده صالح)

যে ব্যক্তি সকাল ও সন্ধ্যায় এই দুআটি পাঠ করবেকোনো জিনিস তার ক্ষতি করতে পারবে না। 

মুজামে আওসাততবারানীহাদীস ৫২৩

রেওয়ায়েত দুটিতে বলা হয়েছেসকাল ও সন্ধ্যায় দুআটি পড়লে উপকার হবে। উদ্দেশ্য হল সকালে পড়লে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যায় পড়লে সকাল পর্যন্ত বিচ্ছুর অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। এই ব্যাখ্যা হাদীসটিরই এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রাহ. নিজ সনদে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেছেননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

مَنْ قَالَ حِينَ يُصْبِحُأَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ، لَمْ يَضُرَّه عَقْرَب حَتَّى يُمْسِيَ، وَمَنْ قَالَ حِينَ يُمْسِي لَمْ يَضُرَّهُ حَتَّى يُصْبِحَ.

যে ব্যক্তি সকালে

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ.

বলবেসন্ধ্যা পর্যন্ত বিচ্ছু তার ক্ষতি করতে পারবে না। আর যে সন্ধ্যায় বলবে সকাল পর্যন্ত বিচ্ছু তার ক্ষতি করতে পারবে না। Ñমুসনাদে আবু হানীফাআবু নুআইমপৃ. ২৫৭কিতাবুল আসারআবু হানীফারেওয়ায়েতে আবু ইউসুফহাদীস ২১৪নাতাইজুল আফকারইবনে হাজার ২/৩৬০মুসনাদে আবু হানীফাহাসকাফীহাদীস ৯

অতএব সকালে এই দুআ পড়লে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যায় পড়লে সকাল পর্যন্ত বিচ্ছুর ক্ষতি থেকে আল্লাহ হেফাযত করবেন।

এডিস মশাসাপ ইত্যাদি কীট-পতঙ্গের বিষক্রিয়া থেকেও হেফাযতে থাকবে

ওপরের রেওয়ায়েতগুলোতে যদিও শুধু বিচ্ছুর ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার কথা বর্ণিত হয়েছেতবে অন্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে. দুআটি পড়লে সব ধরনের বিষক্রিয়া ও সকল বিষাক্ত প্রাণীর ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। আবু হুরায়রা রা. বলেননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ

مَنْ قَالَ حِينَ يُمْسِي ثَلاَثَ مَرَّاتٍأَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ، لَمْ يَضُرَّه حُمَةٌ تِلْكَ اللَّيْلَةَ.

যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিনবার উক্ত দুআটি পড়বে ঐ রাতে কোনো (বিষাক্ত প্রাণীর) বিষ তার ক্ষতি করবে না। জামে তিরমিযীহাদীস ৩৬০৪/১সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩৫১৮মুসনাদে আহমাদহাদীস ৭৮৯৮মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস ৩০৪১৮

এই রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে

لَمْ يَضُرَّه حُمَةٌ تِلْكَ اللَّيْلَةَ.

অর্থাৎ যে ব্যক্তি দুআটি পড়বেকোনো حُمَةٌ (হুমাহ) তার ক্ষতি করবে না। হুমাহ হল বিষ। তদ্রƒপ এর অর্থ হলকীট-পতঙ্গের হুলযা দিয়ে সে দংশন করে। কারণ হুল দিয়েই তার বিষ বের হয়। তো এই রেওয়ায়েতে ব্যাপকভাবে বলা হয়েছেদুআটি পড়লে কোনো বিষ বা হুল ক্ষতি করবে না।

একটি বর্ণনায় আরো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে

مَنْ قَالَ حِينَ يُمْسِي ثَلاثَ مَرَّاتٍ أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ، لَمْ يَضُرَّهُ لَسْعَةٌ تِلْكَ اللَّيْلَةَ.

যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিনবার দুআটি পাঠ করবে ঐ রাতে কোনো لَسْعَةٌ (লাস্আহ) তথা কোনো (বিষাক্ত প্রাণীর) দংশন তার ক্ষতি করবে না। Ñমুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস ৩০৪১৮

আগে উল্লিখিত একটি বর্ণনায়ও ব্যাপকভাবে বলা হয়েছেযারা এই দুআটি পড়বেকোনো কিছুর ছোবল তাদের ক্ষতি করবে না। সেই বর্ণনায় এসেছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ

مَنْ قَالَ حِينَ يُصْبِحُ وَحِينَ يُمْسِيأَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ، لَمْ يَضُرَّهُ شَيْءٌ.

যে ব্যক্তি সকাল ও সন্ধ্যায় দুআটি পাঠ করবে কোনো জিনিস তার ক্ষতি করতে পারবে না। Ñমুজামে আওসাততবারানীহাদীস ৫২৩

উক্ত দুআর উপকারিতা যে ব্যাপকশুধু বিচ্ছুর সাথে নির্দিষ্ট নয়বিষয়টি আরো জোরালোভাবে প্রমাণ করে হাদীসটির বর্ণনাকারী সুহাইল ইবনে আবু সালেহের বক্তব্যÑ

فَقَالَتْهَا امْرَأَةٌ مِنْ أَهْلِي، فَلَدَغَتْهَا حَيَّةٌ، فَلَمْ تَضُرَّهَا.

আমার পরিবারের এক নারী দুআটি পড়েছে। অতঃপর তাকে একটি সাপ দংশন করেছেকিন্তু তার কোনো ক্ষতি হয়নি। Ñজামে মামার ইবনে রাশেদহাদীস ১৯৮৩৪মুসান্নাফে আবদুর রায্যাকহাদীস ২০৭৪৪

এখানে এসেছেদুআটি পড়ার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা সাপের ছোবলক্রিয়া থেকে রক্ষা করেছেন। সুতরাং বোঝা গেলদুআটি পড়লে শুধু বিচ্ছু নয়অন্য সব বিষাক্ত জীবের বিষক্রিয়া থেকেও আল্লাহ আমাদের হেফাযত করবেন।

দুআটি পড়েছেনিরাপদ থেকেছে

আবু হুরায়রা রা. থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবু সালেহ যাকওয়ান রাহ.। বর্ণনা করার পর আবু সালেহ রাহ. বলেন-

فَعَلَّمْتُهَا ابْنَتِي وَابْنِي، فَلَدَغَتْهُمَا فَلَمْ يَضُرَّهُمَا بِشَيْءٍ.

আমি আমার মেয়ে ও ছেলেকে দুআটি শিখিয়েছি। (তারা তা পড়েছে।) এরপর বিচ্ছু তাদের ছোবল দিয়েছে। কিন্তু এতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস ৩০৪১৭

আবু সালেহ যাকওয়ান রাহ. থেকে বর্ণনা করেছেন তাঁর ছেলে সুহাইল ইবনে আবু সালেহ রাহ.। তিনি হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন-

فَكَانَ أَهْلُنَا تَعَلَّمُوهَا فَكَانُوا يَقُولُونَهَا كُلَّ لَيْلَةٍ فَلُدِغَتْ جَارِيَةٌ مِنْهُمْ فَلَمْ تَجِدْ لَهَا وَجَعًا.

আমাদের পরিবারের লোকেরা দুআটি শিখেছিল এবং তারা প্রতি সন্ধ্যায় তা পড়ত। একদিন আমাদের এক মেয়ে দংশিত হয়েছে। কিন্তু সে এর কোনো ব্যথাই অনুভব করেনি। -জামে তিরমিযীহাদীস ৩৬০৪/১সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩৫১৮মুসনাদে আহমাদহাদীস ৭৮৯৮

দুআ পড়লে আর কোনো পরোয়া নেই

হাদীসটির বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা রা.-এর শিষ্য আবু সালেহ রাহ.-কে যখন বলা হতঅমুককে দংশন করেছেতিনি জিজ্ঞেস করতেনসে কি আজ-

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

-পড়েছিল?

যদি বলা হতহাঁতাহলে তিনি আর কোনো চিন্তা করতেন না।

আবু সালেহের ছেলে সুহাইল রাহ. বলেন-   

فَكَانَ أَبِي إِذَا لُدِغَ أَحَدٌ مِنَّا يَقُولُقَالَهَا؟ فَإِنْ قَالُوانَعَمْ، قَالَكَأَنَّهُ يَرَى أَنَّهَا لَا تَضُرُّهُ.

আমাদের কেউ দংশিত হলে আব্বাজী জিজ্ঞেস করতেনসে কি দুআটি পড়েছিল?

তারা যদি বলতেনহাঁতাহলে আব্বাজি ইশারা করতেনআচ্ছাসমস্যা নেইএতে কোনো ক্ষতি হবে না। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৫৭০৯২৩৬৫০

দংশনের পরও পড়া যায় দুআটি

কেউ যদি দুআটি না পড়েআর বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ তাকে দংশন করেতাহলে এই দুআ পড়লে উপকার হবে। আবু হুরায়রা রা.-এর নিকট এমন কাউকে উপস্থিত করা হলে তিনি দুআটি পড়ার নির্দেশ দিতেন। তাঁর শিষ্য আবু সালেহ রাহ. বলেন-

فَكَانَ أَبُو هُرَيْرَةَ إِذَا لُدِغَ إِنْسَانٌ مِنَّا أَمَرَهُ أَنْ يَقُولَهَا.

আমাদের কেউ (কোনো বিষাক্ত জিনিস দ্বারা) দংশিত হলে আবু হুরায়রা রা. তাকে এই দুআ পড়ার নির্দেশ দিতেন।-সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ১০৩৬

সারকথা

আমরা সকালে তিনবার বলব-

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ.

তাহলে সব ধরনের কীট-পতঙ্গের ক্ষতি থেকে সারাদিন আল্লাহ তাআলা আমাদের নিরাপদ রাখবেন।

সন্ধ্যায়ও তিনবার বলব-

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ.

তাহলে সকল প্রকার বিষাক্ত জীবের অনিষ্ট থেকে সারা রাত আল্লাহ তাআলা আমাদের রক্ষা করবেন। এডিস মশার ভাইরাস থেকেও ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদের মুক্ত ও নিরাপদ রাখবেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সব ধরনের মহামারিরোগ-বালাই থেকে হেফাযত করুন এবং এই দুআসহ কুরআন-হাদীসে উল্লিখিত হেফাজতের সকল দুআ থেকে পরিপূর্ণ উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুনÑ আমীন। 


শেয়ার করুন

0 coment rios: